S-400 এবং ভারতের বলিষ্ঠ বিদেশনীতিঃ বহুমেরু বিশ্বের প্রতি একটি পদক্ষেপ

সোমদীপ ভট্টাচার্য্য: কিছুদিন আগেই ভারতে এসেছিলেন রশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাডিমির পুতিন এবং এখানে এসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে। তখনই রাশিয়ার সাথে ভারতের সই হয়েছে #S400 ডিফেন্স ডিল। ৫.৪৩ বিলিয়ান ডলারের বিনিময়ে ভূমি থেকে আকাশে আক্রমণকারী মিসাইলের এই প্যাক্টটি সই হল, এই মূহুর্তে এটি পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী ভূমি থেকে আকাশ ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর মধ্যে একটি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য রাশিয়ার উপরে আমেরিকা সহ নেটোভুক্ত দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেই অবস্থায় এই চুক্তিটা হওয়ায় ভারতের উপরেও সেই নিষেধাজ্ঞা লাগু হবার সম্ভাবনা থাকে,তা সত্ত্বেও ভারত এই চুক্তিতে সাক্ষর করল। ভারতের আকাশ এরফলে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে। এছাড়া এর সাথে ভারতের বিদেশনীতি এবং বর্তমান সরকারের বহুমেরু বিশ্বের নীতিও প্রতিষ্ঠা পাবে। একদিকে তারা আমেরিকার সাথে ভাল সম্পর্ক রাখছে, ডিফেন্স ডিল ও ব্যবসায়িক চুক্তি করছে, অন্যদিকে ইরান থেকে স্বল্পমূল্যে ভারতীয় টাকায় তেল কিনছে আবার নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা রাশিয়ার থেকে অস্ত্র কিনছে।
তবে মিডিয়া এতে একতরফাভাবে ভারতের যে লাভ দেখাচ্ছে সেটাও ঠিক নয়। ভারত যেমন অস্ত্র পাচ্ছে, তেমনই রাশিয়ান ইকোনমি যেটা ধুকছে নিষেধাজ্ঞার ফলে; সেই রাশিয়াও ৫.৪৩ বিলিয়ন ডলারের বুস্ট পাবে এবং রুবল (রাশিয়ার কারেন্সি) শক্তিশালী হবে।

সাউথ_ব্লকের_ভূমিকা :
সাউথ ব্লকেও খুশির হাওয়া ওঠে যখন শোনা যায় মোদী ও পুতিনের মধ্যে চুক্তিটি নিরধারিত হয়ে গেছে। পুতিনের সফরের আগেও এই চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। সাউথ ব্লকে ফরেন এফেয়ারসের দফতরে একটা ইয়ার্কি চলছিল।
– আচ্ছা,কংগ্রেস যদি এতে বাধা দেয়?
– কোন কংগ্রেস? মার্কিনী কংগ্রেস না ভারতীয়?
বিরোধী দলের রাফায়েল নিয়ে ভূমিকা দেখার পর সরকারও মেপে পা ফেলতে চাইছিল।
অনেকাংশেই সাউথ ব্লককেও আড়ালে রাখ হয়েছিল যাতে কোনো খবরই বাইরে না বেরোয়।

আমেরিকার_ভূমিকা:
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আমেরিকার সফরে যান, সেখানে আমেরিকার স্টেটের সেক্রেটারী মাইক পম্পেও,ডিফেন্স সেক্রেটারি জেমস ম‍্যাটিস এবং আমেরিকান এনএসএ তাকে বারংবার জানায় যাতে ভারত রাশিয়ার উপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে কোনো চুক্তি না করে,তাই ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিরমলা সীতারামনকে বলে এই চুক্তি আরো পিছিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল।
ইরানের উপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা,ত সত্ত্বেও একদিকে ইরানের থেকে তেল কেনা ও অন্যান্য স্ট্রাটেজিক সম্পরক রাখা এবং ছাবাহারে বন্দর বানানো; ট্রাম্প সরকার কোনোটাই ভালভাবে দেখছে না।

S400-এর ব্যাপারে কিছু তথ্য বিস্তারিত ভাবেঃ

 এই চুক্তিটি রাশিয়ার গভমেণ্টের সাথে ভারতের গভমেন্টের সই হয়েছে কোনো প্রাইভেট সংস্থার অন্তর্ভুক্তি না থাকায় এর খরচ কম হয়েছে। গভমেন্ট টু গভমেন্ট চুক্তি,মস্কো ও দিল্লীর মধ্যে।

 একটি সিঙ্গেল সিস্টেমে ৮টি ডিভিশন রয়েছে। এর একটি ব্যাটালিয়ন ৭২টি লঞ্চারকে কন্ট্রোল করতে পারে। সর্বোচ্চ ৩৮৪টি মিসাইল ধারণ করতে পারে।

 এই সিস্টেমটিকে ক্রেমলিনের হাতে থাকা সবথেকে শক্তিশালী ভূ-আকাশ রক্ষাকবচ বলা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফরে এই চুক্তিটি চুড়ান্ত হয়েছে। ২০১৪ সালে চীনের সাথে রাশিয়ার এই একই অস্ত্রচুক্তি সই হয়েছে এবং রাশিয়া ইতিমধ্যেই চীনকে এর ডেলিভারী দেয়া শুরু করে দিয়েছে। তবে কত সংখ্যা, মূল্য বা এগুলির ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না।

 S-400 হল S-300 এর অত্যাধুনিক সংস্করণ। আল্মাজ-আনতের দ্বারা তৈরি সমরাস্ত্রটি ২০০৭ থেকেই রাশিয়ার আকাশরক্ষায় নিযুক্ত রয়েছে। ২০১৪ সালে “দ্যা ইকোনমিস্ট” পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন লেখা হয় S-400 কে কাটাছেঁড়া করে, সেখানে এর সম্বন্ধে বলা হয় “one of the best air-defence systems currently made” সিস্ট্রমটি এতোটাই উচ্চ মানের।

 আকাশপথেই ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের ক্ষমতা এই S-400 সিস্টেমের আছে, এমনকি যদি সেই ক্ষেপণাস্ত্র নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড সম্পন্ন হয় তাও।

 এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেটকেও এক লহমায় মাটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম। আর এটাই চীন আর আমেরিকার সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কারণ। বিশেষত চীন তাদের আকাশপথে এসল্টের এডভাণ্টেজ হারাবে এবং তাদের ভারতকেন্দ্রিক ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ বিমান কোনো কাজেই আসবে না।

ভারতে,চীন ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে এর প্রভাবঃ
এখনো পরিস্কারভাবে না জানালেও শোনা যাচ্ছে চীন ৪ বা ৬ ডিভিশন S-400 এর ডিল করেছে যার মূল্য ৩বিলিয়ান ডলারের মত,কিন্তু মিসাইল সংখ্যা ভারতের থেকে অনেক কম। রাশিয়া মোট ১৯ রেজিমেন্ট S-400 ব‍্যাবহার করে বলে শোনা যায়।ভারত আরো ৫ রেজিমেন্ট S-400 অর্ডার দেবে বলে শোনা যাচ্ছে, যার ক্ষমতা ও রেঞ্জ চীনের থেকে যথেষ্টই বেশি। রাশিয়া ছাড়া বেলারুশ,আলজেরিয়া ,তাছাড়া সৌদি আরব তিন বিলিয়ন ডলার এবং তুরস্ক আড়াই বিলিয়ন ডলার দিয়ে রাশিয়ার সাথে S-400 মিসাইল ক্রয়ের চুক্তি করতে চলেছে।
এমতাবস্থায় ভারতের সাথে ইস্রাইলের ডেভিডস স্লিং কেনার কথাও চলছিল এবং তৃতিয় কোনো শক্তিও চাইছিল যাতে এত বড় অর্থ ভারত রাশিয়াকে না দিয়ে, ইস্রায়েলকেই দেয়। যার ফলে আমেরিকার অক্ষশক্তিতে থাক মিত্ররাই শক্তিশালী হয়।
কিন্তু অন্যদিকে আবার এই সুযোগে পাকিস্তান, রাশিয়ার কাছাকাছি আসতে শুরু করে এবং রাশিয়ান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি ও S-400 নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। যদিও এটি কেনার আর্থিক ক্ষমতা তাদের নেই।
এই চুক্তির মাধ্যমে মোদীসরকার এক ঢিলে রাশিয়াকেও বশ করল,অন্যদিকে পাকিস্তানের S-400 কেনার পথও বন্ধ করে দিল। ভারত রাশিয়ার সাথে ‘রাইডার ক্লজ’ বলে একটি বিষয় রেখেছে,যে বিষয় অনুযায়ী রাশিয়া পাকিস্তানকে কখনোই এই সিস্টেম বেচতে পারবে না BBC সম্প্রতি এই বিষয়টি জানায়।
EurAsia নামক সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন “এস-৪০০ ডিল পাকিস্তানের জন্য বড় হুমকি স্বরূপ। এই সিস্টেম ডেলিভারি পেলে ভারত পাকিস্তানের প্রায় সম্পূর্ণ আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ভারত আমেরিকার থেকে অস্ত্র কেনায় পাক রুশ সম্পর্ক ভালো হচ্ছিল। ভারত বুঝেছিল পাক অর্থনীতি দূর্বল হলেও তারা রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কিনতে পারে। সেই বুঝেই তারা রুশের থেকে এস-৪০০ নেয় এই শর্তে যে তারা পাকিস্তানকে এই অস্ত্র বেচবে না”।

অন্যন্য_কিছু_চুক্তি (সমসাময়িক) ও তাদের প্রভাবঃ
এই ডিলটি ছাড়াও গত শুক্রবার চারটি গ্রিগোভীচ ফ্রীগেট,দুইশ কা-২২৬টি হেলিকপ্টার, সাড়ে ছয় লক্ষ একে-১০৩ এর চুক্তির বিষয়েও কথা হয়েছে যা নিয়ে কিছু বিবৃতি দেওয়া হয়নি। এস-৪০০ এর আওতায় পাকিস্তানের পুরো আকাশই চলে এসেছে, অওয়াক্স থেকে শুরু করে পাকবাহিনীর সমস্ত বিমানই এখন ভারতের রেঞ্জে চলে এল। ফলে ডিফেন্স ছাড়াও ভারতের অফেন্সের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা থাকবে এবং ক্রমশঃ দেশের কমে আসা বিমাণবাহিনীর আক্রমণ ক্ষমতাকেও কিছুটা সাহায্য দেওয়া যাবে।

তথ্যসূত্রঃ
১)অবিনাশ শ্রীবাস্তবের তথ্য সহায়তা।
২)বেঙ্গলী ডিফেন্স নিউজ।
৩)ইউরেশিয়া।
৪)হিন্দুস্তান টাইমস।
৫)ডিফেন্স নিউজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here