প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিলো জানেন?

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নিজের দেহরক্ষীদের হাতে খুন হন। সেই  সময় তিনি ছিলেন তার নয়াদিল্লির সফদর জং রোডের বাসভবনে । তাকে গুলি করে হত্যা করে তার দু’জন শিখ দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং । এই ঘটনার কয়েকমাস আগে জুনের প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে পরিচালিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সামরিক অভিযান । এই অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে । বলা হয়ে থাকে, সে অভিযান ইন্দিরা সরকারের প্রতি শিখসমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অনুমান করা হয়, সে সূত্রেই সৃষ্ট ক্ষোভের জের হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধী খুন তার দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে।

১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী । তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। আবার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৮০ সালে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত। তিনিই ভারতের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী।

ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য যাওয়ার পথে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের সময় তিনি খুন হন। এই ব্রিটিশ অভিনেতা আইরিশ টেলিভিশনের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন। ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছের ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে তখন হাঁটছিলেন। তিনি যখন সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংহের প্রহরাধীনে উইকেট গেট (বিশেষ কোনো বড় দরজার পাশে বা ভেতরে থাকা ছোট দরজা) দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন এরা তার ওপর গুলি ছোড়ে। সাব-ইনস্পেক্টর বেয়ান্ত সিং তার সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন তার তলপেটে। এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সতওয়ান্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়ই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন। তখন বেয়ন্ত সিং বলেন, ‘যা করার ছিল, আমি তা করে ফেলেছি, তুমি যা করতে চাও করো’। পরবর্তী ৬ মিনিটের মধ্যে ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশের রমেশ সিং জামওয়াল ও রাম শরণ বেয়ান্ত সিংকে ধরে একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে হত্যা করে। কারণ অভিযোগে প্রকাশ বেয়ান্ত সিং এ কক্ষের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

অপর দিকে গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিংকে গ্রেফতার করে। তার সাথের পালাতে যাওয়া একজনও গ্রেফতার হন। বেয়ান্ত সিংয়ের হামলার সময় তিনি মারাত্মক আহত হন । বেয়ান্ত সিংকে তার সঙ্গী কেহার সিংসহ ১৯৮৯ সালে ফাঁসি দেয়া হয় দিল্লির তেহার জেলে। অভিযোগ আছে, ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি আর কে দেওয়ানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ইন্দিরার পাহারা থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে দিতে । আর কে দেওয়ান তা উপেক্ষা করেন। উল্লেখ্য, বেয়ান্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে । ঘটনার সময় অন্য খুনি সতওয়ান্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর । ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়।

দূরদর্শনের অ্যাংকর টেলিভিশন সাংবাদিক সালমা সুলতানা ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দূরদর্শনের সন্ধ্যার খবরে ইন্দিরা হত্যার খবর প্রচার করেন। এ খবর প্রচারিত হয় তাকে গুলি করার ১০ ঘণ্টা পর। সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে নেয়া হয় অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। সেখানে তার ওপর অপারেশন চালানো হয়। বেলা ২টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এরপর চলে ময়নাতদ ন্ত। ময়নাতদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন ডা: টি ডি ডোগরা। তিনি বলেন, কমপক্ষে ৩০টি বুলেট বিদ্ধ হয় ইন্দিরার শরীরে । বুলেট ছোড়া হয় স্টেনগান ও পিস্তল থেকে। খুনিরা ৩১টি বুলেট ছুড়লেও একটি তার গায়ে লাগেনি । ৩০টি গুলির মধ্যে ২৩টি গুলি শরীরের এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭টি গুলি দেহের ভেতরেই থেকে যায় । ডা: ডোগরা ইন্দিরার দেহ থেকে বের করে আনা বুলেটগুলোর ব্যালিস্টিক এক্সামিনেশনের মাধ্যমে নির্ণয় করেন এগুলো কী ধরনের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছে । এই বুলেটগুলো সিএফসিএল দিল্লির সংশ্লিষ্ট অস্ত্রের সাথে মিলে যায় । পরবর্তী সময়ে ডা: ডোগরা একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাজির হন শ্রী মহেশ চন্দ্রের আদালতে। আদালত কয়েকটি অধিবেশনে তার সাক্ষ্য নেয়। তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের উকিল শ্রী পি এন লেখি।

১ নভেম্বর তার মৃতদেহ একটি গানবহরে করে দিল্লির রাস্তা দিয়ে নিয়ে রাখা হয় তিন মূর্তি ভবনে। মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ রাজঘাটের কাছের শক্তিস্থল নামে এক স্থানে তার শেষকৃত্য হয় ৩ নভেম্বর। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন ও বিবিসিসহ রেডিওতে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার তদন্তের  তদন্তের জন্য জাস্টিস ঠক্কর কমিশন ষড়যন্ত্রের জন্য পৃথক তদন্তের পরামর্শ দেয় । অভিযুক্ত সৎবন্ত সিংহ ও ষড়যন্ত্রকারী কেহার সিংহমৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন । ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাঁদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। সৎবন্ত সিংহই শেষ ব্যক্তি যাকে দিল্লির তিহার জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়

error: Content is protected !!