রিলায়েন্স ডিফেন্সকে ৩০,০০০ কোটি টাকার অফসেট সম্পূর্ণ অসত্যঃ ড্যাসাল্ট এভিয়েশনের সিইও

অর্ঘ্য মাহাতোঃ ড্যাসাল্ট এভিয়েশনের সিইও, এরিক ট্র‍্যাপিয়ার ইকোনমিক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাফেল যুদ্ধবিমানের চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। তিনি বলেন যে, ২০১১-১২ সালে তারা রিলায়েন্সের সাথে চুক্তি করেছিল। এটি ফ্রান্সের পূর্ব রাস্ট্রপতি অল্যাঁদের সময় নয়, আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সময়ও নয়। সাক্ষাৎকারটি বিস্তারিত ভাবে নীচে প্রকাশ করা হলো।

প্রশ্নঃ রাফায়েল চুক্তির জন্য রিলায়েন্স ডিফেন্সকে ৩০,০০০ কোটি টাকার অফসেট দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিরোধী দল। এটা কি সত্য?

এটা সম্পূর্ণ অসত্য। ২০১১ সাল থেকে রিলায়েন্সের সাথে আমাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। গত ৬৫ বছর ধরে আমরা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করছি। আমরা ভারতকে সাহায্য করতে চাই কারণ তারা নিজস্ব শিল্প বিকাশ করতে চায়। আমরা আমাদের প্রযুক্তি ভারতে হস্তান্তর করার জন্য ব্যক্তিগত অংশীদার খুঁজছি। আমরা  রিলায়েন্সকে অংশীদার করেছিলাম কারণ এটি আমাদেরকে সুযোগ সুবিধা দেবে এবং ওরা আমাদের ভারতের ব্যবসা সম্পর্কে জানাতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারীতে মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বাধীন রিলায়েন্স গ্রুপের সাথে  আমরা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি, প্রায় একই সময়ে রাফায়েল নির্বাচিত হয় এবং আমরা তখন থেকে একসাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমার উদ্দেশ্য হল  সম্পূর্ণ অফসেটের চুুক্তির নিয়ম মেনে চলা, উপযুক্ত পরিকাাঠামো তৈরি করা এবং ডাসল্টের জন্য সহজ সরবরাহ ক্ষেত্র তৈরি করা।

প্রশ্নঃ রিলায়েন্স ডিফেন্সে ৩০হাজার কোটি টাকার অফসেট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে?

আমাদের শেয়ারের সাথে সঙ্গতি রেখে, আমরা ৭০কোটি টাকা দিয়ে যৌথ উদ্যোগে ৪৯% বিনিয়োগ করেছি। আমরা ধীরে ধীরে লগ্নির পরিধি বৃদ্ধি করবো। এই পরিকল্পনাটিতে লগ্নির পরিমান ৮৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছবে। সুতরাং, আমাদের বিনিয়োগ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ৪২৫কোটি (৪৯%) হবে।

যে পরিমান টাকার কথা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। অফসেটের  নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তিটি ফ্রান্স ও ভারত সরকারের মধ্যে হয়েছিল এবং একই সঙ্গে ড্যাসল্ট, ডিফেন্স  প্রিকিউরমেন্ট প্রসিকিউটর (ডিপিপি) ২০১৩ নিয়ম অনুযায়ী অফসেটের জন্য চুক্তিতে  স্বাক্ষর করেছিল।

রিলায়েন্স ও ড্যাসাল্ট যৌথ উদ্দ্যোগে ফ্যালকনের অংশ তৈরি করবে এবং সম্ভব হলে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ ফ্যালকন২০০০ তৈরি করবে। আমরা অফসেটের জন্য কিছু অর্থ পাব। আজ যদি আপনি আমাদের বিভিন্ন সংস্থার সাথে চুক্তির তথ্য দেখেন, আমরা ইতিমধ্যেই ৩০টি  কোম্পানির সাথে ৪০% চুক্তি করেছি। এইগুলির মধ্যে একজন রিলায়েন্স, যে ৪০% এর ১০% পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্নঃ কিন্তু, রিলায়েন্স প্রেস রিলিজে বলেছে যে তারা ৩০,০০০ কোটি টাকার অফসেটের অংশীদার?

গুরুত্বপূর্ণ হল আমরা কি করতে যাচ্ছি। ফ্যালকন তৈরি করতে, তার অংশ এবং রাফায়েলের অংশ উৎপাদন করতে চলেছি। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল, পশ্চিমী দেশের সাথে সমমানের উৎপাদনের ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আমাদের বিশ্বব্যাপী কোম্পানি হতে গেলে সঠিক মানের উৎপাদন করতে হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হল আমাদের রিলায়েন্সের সঙ্গে যৌথ ভেন্চার একটি গ্লোবাল অ্যারোনটিক্যাল কোম্পানি হতে যাচ্ছে যা শূন্য থেকে থেকে শুরু করছে।

প্রশ্নঃ রাফেলের জন্য অফসেটের বাকি কোম্পানিগুলো কী ?

আমদের একটি তালিকা আছে, আমরা ১০০টিরও বেশি কোম্পানির সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ত্রিশটি কোম্পানিকে ইতিমধ্যেই যুক্ত করা হয়েছে। তারা রয়েছে মুম্বাইয়ে, ব্যাঙ্গালোরে, সারা দেশে জুড়ে।ঃ

প্রশ্নঃ রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোঁয়া অল্যাঁদের বিবৃতিতে অনেক বিভ্রান্ত ছড়িয়েছে। এই চুক্তির জন্য রিলায়েন্সের সাথে অংশীদারিত্ব বাধ্যতামূলক ছিল?

এটা খুবই সহজ, মিঃ অল্যাঁদ নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে দুটি কোম্পানি তাদের নিজস্ব অংশীদারের ভিত্তিতে চুক্তি করেছে।

আমরা ২০১১-১২ সালে রিলায়েন্সের সাথে চুক্তি করেছি। এটি অল্যাঁদের সময় নয়, আপনার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে রিলায়েন্স নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি এটা পরিষ্কার করতে চাই যে ড্যাসল্ট এভিয়েশন রিলায়েন্সের সাথে চুক্তি করে কারণ আম্বানীরা খুব সম্মানিত পরিবার। দুই ভাই ও তাদের মা ভারতে সুপরিচিত। আমরা একটি পরিবার মালিকানাধীন সংস্থা এবং আমরা অন্য পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

প্রশ্নঃ অফসেটের জন্য রিলায়েন্সকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় পক্ষ থেকে কোন  চাপ ছিল?

একদমই না। ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট পলিসির নিয়ম অনুসারে অফসেট ঠিকাদারের পছন্দ।

ভারতে অংশীদারদের নির্বাচন সম্পর্কে ফরাসি সরকারের  কিছুই বলার নেই। যখন আমি অংশীদার বাছাই করি তখন এটি আমার দায়িত্ব হয়ে ওঠে, মানদণ্ড এবং সময়কালের মধ্যে দায়িত্ব পালন করা।

প্রশ্নঃ ৩৬টি রাফেল জেটের জন্য ভারত কি আগের চেয়ে বেশি চুক্তির অর্থ প্রদান করেছে?

এখানে একটি মিশ্র চুক্তি আছে। আমি মূল্যের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করতে চাই না তবে আমি যা বলতে পারি তা হল ১২৬টি রাফেল জেটের জন্য আগে আমাদের একটি প্রস্তাব ছিল। এটির দুটি অংশ ছিল। প্রথমটি ছিল সম্পূর্ণ উড়ার অবস্থায় ১৮টি বিমানের জন্য এবং দ্বিতীয়টি ছিল ১০৮টি বিমানের উৎপাদন, যার মধ্যে সরঞ্জাম, জগস, ম্যানআওয়ার এবং ডকুমেন্টেশন  অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 ১৮টি ফ্লাইওয়ে রাফায়েল ইউনিটের দাম সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। সাপোর্ট (খুচরা যন্ত্রাংশ)  মানিয়ে নিতে পরিবর্তিতে ৩৬টি ইউনিট হয়েছিল। তারপর, আমরা MOD এর সাথে আলোচনা শুরু করেছিলাম। মূল্য খুব কম রাখা হয়েছিল এবং মোট মূল্যের ৯% ছাড় ছিল।

যদি দাম দ্বিগুণ হত, তাহলে আমি কোন চুক্তি ছাড়াই ফ্রান্সে ফিরতাম। একই (ইউপিএ) মূল্যের তুলনায়, ভারত ৯% কমিয়ে এনেছে। বিভ্রান্তি কোথায়? তুল্যমুল্য ভাবে, তুলনা ১৮টি ও ৩৬টি ফ্লাইওয়ে জেটের মধ্যে।

প্রশ্নঃ আপনি কি বিস্মিত হয়েছিলেন যে বিমান কেনার সংখ্যা ১২৬টি থেকে ৩৬টি হয়ে গেল?

এটা ছিল ভারতের সিদ্ধান্ত। আমরা ১২৬টি প্লেনের চুক্তিটি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এবং আমরা হ্যালের সাথে আলোচনা করেছিলাম কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের দারুন সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু কিছু কারণে আমাদের চুক্তি হলনা।

প্রশ্নঃ সমস্যা কি ছিল?

আমরা ২০১২ সালে নির্বাচিত হয়েছিলাম এবং ২০১৫ সালেও আমরা চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে পারিনি। আমি বিস্তারিত বলব না, কেন, তবে বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল।

প্রশ্নঃ অন্যতম ছিল এয়ারক্রাফটের চূড়ান্ত দায়িত্ব কার, ড্যাসল্ট না হ্যালের ?

আমি বললাম যে, প্রথম কয়েকটি বিমানের দায়িত্ব ড্যাসল্টের হওয়া উচিত এবং তারপর এটি হ্যালের হতে হবে। আমাদের হ্যালের সাথে  চমৎকার সম্পর্ক ছিল এবং আমাদের অনেক আলোচনা হয়েছিল কিন্তু কিছু কারণে এতে সম্মতিতে পৌছায়নি।

তারপর, আমি বুঝতে পারি যে আইএএফ ও ভারতের জরুরি প্রয়োজন, তখন  ফ্রান্সকে বিমান সরবরাহ করার অনুরোধ করেছিল এবং ৩৬টি রাফেলের চুক্তি চূড়ান্ত করে দিয়েছিল।

প্রশ্নঃ রাফালের চুক্তিতে সিবিআইয়ের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টেও উপস্থাপনা করা হয়েছে। আপনি চুক্তি নিয়ে তদন্তে রাজি আছেন?

২০০০ সাল থেকে, ফ্রান্সে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর হয়েছে এবং আমরা এটির সাথে রয়েছি। আমরা ফ্রান্সের আইন, ভারতের আইন ও চুক্তির আইন মেনে চলি। আমরা সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ফ্রান্স বা ভারতের কোনো তদন্ত থাকলে আমরা তদন্তের জন্য তৈরী, এটা আমাদের দায়িত্ব (সাড়া দিতে)। আমরা প্রমাণ করব যে, কোন দুর্নীতি নেই। আমরা খোলা, আমরা প্রকৌশলী এবং আমরা ভারতে থাকতে চাই।

আমরা কেবল উৎপাদন করার জন্যই নয় বরং ডিজাইন ও উন্নয়নের জন্য ভারতে দক্ষতার বিকাশ করতে চাই। অনেক সুযোগ আছে এবং আমরা সত্যিই ভারতে উৎসাহী।

একারণেই আমি বিতর্ক নিয়ে একটু দু:খিত। আমি ভারতীয় কোম্পানিগুলির সাথে অংশীদারিত্ব করতে চাই, আমাদের টিম এতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও উৎসাহী।

প্রশ্নঃ আপনি  কি মনে করেন যে ৩৬টি জেটের চুক্তিটি স্বাক্ষরিত করার জন্য আপনি আসন্ন দুইটি চুক্তি (প্রথম ১১০টি লড়াকু বিমান  ভারতে তৈরি করা হবে ও অন্যটি ৫৭টি নৌবাহিনীর জেট ) পেতে সুবিধা হবে?

আইএএফ  বিভিন্ন প্রতিযোগীদের সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করেছিল যার মধ্যে রয়েছে এফ/এ ১৮, গ্ৰিপেন, ইউরোফাইটার ও রাশিয়ান জেট এবং তাদের মধ্যে, রাফায়েলকে  সেরা হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল।

সুতরাং, এটি আমাদের একটি সুবিধা দেয়। অন্য সুবিধা হল ৩৬টি জেটের চুক্তিতে পাইলট, মেকানিক ও সহায়তা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

আমি উভয় চুক্তি পেতে চেষ্টা করব কারণ রাফেল বিমান মালবাহী অপারেশনে সক্ষম। এতে আমাদের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হতে পারে তবে আমাদের কাছে খুব ভাল পণ্য রয়েছে। ফরাসি বাহিনী শুরু থেকেই স্থল-ভিত্তিক এবং বিমান বাহক অপারেশন, উভয়ে সক্ষম বিমান রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাফায়েল ভারতের আবহাওয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব দেবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here