বিতর্কের সবরীমালা: অজানা তথ্যের প্রেক্ষাপটে তৈরি বিতর্ক

অর্ঘ্য মাহাতোঃ দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের প্রাচীন মন্দিরের রীতিকে নিয়ে তৈরী হওয়া বিতর্ক আজ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, ভক্তিতে  লিঙ্গ সমানতা নাকি লিঙ্গ  নিরপেক্ষতা, কোন অর্থে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিভেদতা প্রতিফলিত হবে ? হাজার বছর ধরে চলে আসা এই মন্দিরের নিয়ম অনুসারে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ । ধর্মীয় প্রার্থনাতে এইরকম বিধিনিষেধ সমাজের একটি লিঙ্গের অধিকার খর্ব করা নইকি ? পুরুষের ক্ষেত্রে এই নিষেধ থাকবে না কেন ?

 পশ্চিমীঘাট পর্বতমালার পেরিয়ার বাঘ সংরক্ষণের পাঠানামথিতটা জেলাতে মন্দিরের অবস্থান সমুদ্রতল থেকে ৪৮০ মিটার উচ্চতায় । চারপাশে অরণ্য সমৃদ্ধ্য এই মন্দিরে ভগবান আয়াপ্পান পূজিত হন । তার ভক্তদের অন্যতম চিহ্ন তাদের মাথায় ছাই দিয়ে সমান্তরাল ভাবে আঁকা বিভূতি । প্রতি বছর এখানে দুই কোটির ওপর ভক্তের সমাগম হয় ।

বর্তমান সময়ে বিতর্কের সূত্রপাত ১৯৯১ সালে কেরালা হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায় যেখানে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, ঋতুকালে থাকাকালীন  নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় ।  পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে  ইন্ডিয়ান ইয়ং লাউয়ার্স এসোসিয়েশন সংবিধানে ২৫তম অনুচ্ছেদে দেওয়া ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের  অভিযোগে  সুপ্রিম কোর্টে  পিটিশন জমা দেয় । এরপরে সমস্ত পক্ষের বক্তব্য শুনে সুপ্রিম কোর্ট ১৭ই জুলাই ২০১৮ তে পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করে শুনানি  শুরু করে । যার ফলস্বরূপ ২৮সে সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে কেরালা হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে প্রত্যাখ্যান করে সমস্ত বয়সী নারীদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেয় ।

এ তো গেলো লিঙ্গের ধর্ম সমানতার দীর্ঘ লড়াই । কিন্তু একপক্ষের দৃষ্টিতে, একটি মতের যুক্তিতে দেখে  অন্য দৃষ্টিভঙ্গিকে না বুঝে , না শুনে  তুচ্ছ করলে সত্যিটা জানা অধরাই থেকে যাবে। অন্যপক্ষ কোন যুক্তিতে  বর্তমান সময়েও নারীর অধিকারকে খর্ব করে রাখতে চাইছে? তাও আবার এমন একটি রাষ্ট্রে যেখানে তেত্রিশ কোটি ভগবান তৈরী করা হয়েছে , যে ভূমির মানুষ প্রতিটি কণায় ভগবানের অবস্থানে বিশ্বাসী , যে ধর্মে মন্দিরই ভক্তির একমাত্র স্থান নয়, যেখানে একটি পরিবারের মধ্যে একাধিক ভগবানে বিশ্বাসী ভক্তের স্থান , যে ধর্মে বলা হয়  “যত্র নারায়তসু পূজ্যান্তে , রমন্তে  তত্র  দেবতা” অর্থাৎ যেখানে নারীকে প্রাপ্য  সম্মান দেওয়া হয় সেখানেই ভগবানের অবস্থান। তাহলে কি আমরা সবরীমালা সম্পর্কে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছি ? নারী শক্তির স্বরূপে আমরা দেবী দুর্গাকে পুজো করে থাকি , পুরুষের শক্তি স্বরূপ মহাদেব , বিদ্যার স্বরূপ দেবী সরস্বতী , অর্থের স্বরূপে দেবী লক্ষী , কারিগর রূপে বিশ্বকর্মা । অর্থাৎ আমাদের প্রয়োজনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ ভগবানের  স্থান তেমনভাবেই আমরা শচীনকে ক্রিকেটের ভগবানের স্থান দিয়েছি ।  ভগবান আয়াপ্পানের স্থান ব্রহ্মচারী রূপে, অর্থাৎ বৈদিক আশ্রম ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্রহ্মচর্য জীবনের ১ম ২০ বছর বা ২৫ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্যের অন্তর্গত। প্রাচীন হিন্দু সমাজ অনুযায়ী মানুষের জীবনকালকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হত । এর মধ্যে প্রথম ভাগ হল ব্রহ্মচর্য । অন্য তিনটি হল যথাক্রমে গার্হস্থ্য , বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস । অর্থাৎ ভগবান আয়াপ্পানের অস্তিত্ব ব্রহ্মচারী রূপেই সীমিত। বৈদিক আশ্রমের  নিয়মের  সীমাবদ্ধতে এই সময়  নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কি বলতে পারি যে শুধুমাত্র  একজন নারী হওয়ার অপরাধে তিনি বঞ্চিত হচ্ছেন ? এটাও জেনে রাখা দরকার যে কেরালাতেই এট্টুকাল, চাক্কুলাথুকাভু , ভগতি মায়ের  মন্দিরে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ । সেক্ষেত্রেও কি লিঙ্গের ওপর বিভাজন করা হচ্ছেনা ? তাহলে কেন সবরীমালার ওপর বিতর্ক তৈরী করা হচ্ছে ? উত্তর খোঁজার দায়িত্ব পাঠকের ওপর দিলাম ।

ভগবানের ভক্তিতেই যদি মুক্তি থাকে তাহলে সেই মুক্তির অপেক্ষা কি করা যেতে পারেনা ? করতে পারবে বলেই লাখ লাখ ভক্ত লিঙ্গ বিভেদকে অস্বীকার করে বিরোধিতা শুরু হয়েছে এবং গণতন্ত্রের সর্বশক্তিমানের কাছে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হয়েছে যেটি গ্রাহ্য করা হবে দুর্গাপুজোর ছুটির পর ১৯শে অক্টোবর ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here