ধর্মের ব্যবসায় শিল্পীর পীঠস্থান কলকাতার কুমোরটুলি

ছবি- অর্পণ পাল

অর্ঘ্য মাহাতো(কলকাতা) উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত হুগলী নদী ।  মহানগরীর উত্তরে অবস্থিত,কলকাতা পৌরএলাকার ৯ নং ওয়ার্ডে শোভাবাজারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত কুমোরটুলি।  যার পশ্চিমে নদীতটে ব্যাস্ত জনবসতিতে মৃৎশিল্পীদের বাসস্থান । ভৌগোলিকভাবে আদর্শ এই স্থানেই গড়ে উঠেছে দেব-দেবী তৈরির পীঠস্থান । পীঠস্থান ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে ! যেখানে প্রাচীন শিল্পকলার দর্শন পরিলক্ষিত হয়, যেখানের তৈরী শিল্প ভারত ছাড়াও বিশ্বের চাহিদাই তৈরী হয় দেব-দেবীর মূর্তি ।  বিরাট এই শিল্পকলা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রতিটি স্থানে যেখানে আশ্রিত, মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু নারীর টানে , সংস্কৃতির সাথে যুক্ত ভারতবাসী।

পাশ্চাত্যকথিত ‘ধর্ম’ ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এই ভূমি যেখানে এখনো আহারের সংস্থান করে দিচ্ছে হাজার হাজার মৃৎশিল্পীদের । যেখানে রয়েছে ধর্মের ব্যবসা আবার ব্যবসার ধর্ম । হাঁ, খাঁটি কথাই , দেব-দেবীর মূর্তি তৈরী করার যে শিল্প ও ব্যবসা হাজার শতাব্দী ধরে অন্ন তুলে দিচ্ছে , হাজার মাইল দূরে থেকেও যাদের ভরসার মুখ এই শিল্পীরা তার জন্য আর কি উপমায় বা দেওয়া যেতে পারে ।

মৃৎশিল্পী , যাদের কথা ভাবলেই আমাদের ভাবনায় গ্রাম-বাংলার কথা  আসে । কিন্তু তাদের অবস্থান এই মহানগরীর বুকে কিভাবে ? ইতিহাস পরিলক্ষিত করলে বুঝতে পারা যায় যে, এই বিশাল মহানগরী তৈরী করতে যেমন নগর,বাস্তু কারিগরদের অবদান  রয়েছে তেমনই এই মৃৎশিল্পীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’-এর উৎসবে শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা এই মহানগরীতে সামন্ততান্ত্রিক সময়ে  জমিদার বা বর্তমান সময়ের বিত্তশীল পরিবারদের ঘরে তাদের তৈরী প্রতিমা পূজিত হয় । সময়ের ব্যবধানে সেগুলি পৌঁছে যাচ্ছে পাড়ার অলিগলিতে ও বিদেশের পূজা মণ্ডপে ।

জমিদারি ব্যবস্থায় ওই অঞ্চলে অবস্থিত জমিদাররা তাদের আথিতেয়তার  নিমন্ত্রণ জানাতেন  এই মৃৎশিল্পীদের। বিশেষত দুর্গাপুজোর এক সপ্তাহ পূর্বে তাদের আগমন হতো , তারপরের প্রতিটি সকাল সেই অঙ্গনে বাচ্চাদের জন্য মায়ের আগমনী বার্তার আনন্দস্থানে পরিণত হতো । উৎসাহী বাল্যমন নিষ্পলক দৃষ্টিতে প্রতিমা তৈরির আনন্দ উপভোগ করতো । মাটির বিভিন্ন আকার ও আকৃতি , বিভিন্ন রঙের খেলায় তারা মাতোহারা হয়ে যেত । শিল্পীর ফেলে দেওয়া রং বা মাটি ছিল তাদের খেলার মুখ্য উপাদান । মায়ের বস্ত্রদান থেকে অস্ত্রদান সবকিছুই ছিল তাদের কাছে উৎসবের দিনের এক-একটি মুহূর্ত । তবে সেই বস্ত্রের বা অস্ত্রের প্রতিকৃতি তৈরির আবদার থেকে তাদের পিতা-মাতা  অবকাশ পেতেন না ।

কালের পরিবর্তনে আজ অনেককিছুই ‘মডার্ন’ হয়ে গেছে , আর এই পরিবর্তনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি উৎসবের মুখ্য মূহুর্তগুলিকে । তবে হারায়নি তাদেরকে , তাদের শিল্পীসত্বা আজও আছে , আমাদের কুমোরটুলি আজও আছে । হারায়নি সেই আনন্দের টানকে যার অনুভূতির অংশীদার হতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্তকুলের ভীড় দেখা যায় এই কুমোরটুলির অন্দরে । এই স্মৃতির অংশীদারিত্বে তাদের সময়কে কেউ ফটোবন্দি করে  রাখে মোবাইলে, কেউ সেলফিতে , কেউ ডিজিটাল ক্যামেরাতে আবার কেউ হৃদয়ের আঙিনায় ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here