ঠাকুর দালানে লালরঙা শাড়ি পড়ে দুর্গা, মাঠে ভেজা কাশফুল, দুর্গা ঠাকুর এলো ঘরে।

কল্যাণ অধিকারীঃ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির শারদীয় উৎসব। রাজ্যের সমগ্র জেলায় ফুটে ওঠা কাশফুল ভিজিয়েছে তিতলি। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে ভেসে বেড়ানো পুঞ্জীভূত মেঘমালা চাপা ফেলেছে মুখপুড়ি তিতলি। তবুও বৃষ্টি’র মাঝে আলোকউজ্জ্বল মন্ডপ, ভেজা রাস্তায় আলোর প্রতিচ্ছবি, মলে শেষ মূহুর্তের কেনাকাটা আকাশে বাতাসে বিলিয়েছে পুজোর সুরভি।

দুর্গাপূজা আসলে-ই নতুন শিল্পীর আট খানা বাংলা গানের ভিডিও হতো প্রকাশ। এফ এম হোক বা মন্ডপে লাগানো মাইক, সর্বত্র নতুন গানের আবহে পূজোর আগমনী। টালিউড নায়ক নায়িকাদের সিনেমার রিলিজ। রাজ চক্রবর্তী হলে তো আর কথাই নেই। চুমু থেকে পেটানো, গোটা সিনেমা জুড়ে দক্ষিণী রিমেক। সিনেমা হলে ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমের মাঝে বান্ধবীর নরম তালুতে উষ্ণতার হাত। অভিনয়ের বাতায়নে ফিল্ম সুপারহিট। দর্শক কুল আহা কি দেখলাম জাতীয় জবাব। ফিরবার আগে চিকেন কাবাবে রসিয়ে আস্বাদন। সর্বশেষে টানা রিক্সায় নস্টালজিক।

গ্রামের দিকে আনন্দ টা থাকে আরও একটু বেশি। বাড়ির দেওয়ালে আলপনার প্রলেপ টানা। গোলা দেওয়া উঠোন। বাবা-কাকা-দাদা’র দেওয়া নতুন জামা এ বাড়ি-ও বাড়ি দেখিয়ে মনের দিগন্তে পাহাড়ি প্রশ্বস্তি। পোগ্রাম সেট হয়ে যায় কোনদিন কোথায় ঘোরা হবে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখের পাতায় মাশকারা, চুলে ক্লিনিক প্ল্যাস শ্যাম্পু প্রস্তুতি তুঙ্গে। মায়ের আঁচলের ফাঁক দিয়ে হাত নেড়ে বন্ধুকে  ওইটুকু বলে দেওয়া। ভিড় ঠেলে মন্ডপে মায়ের কাছ থেকে একটু সরে মনের মানুষ টিকে তাকিয়ে দেখে নেওয়া। মাইকে তখন ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে, কিছুক্ষন আরো না হয় রহিতে কাছে।’ ফুচকা খেতে গিয়ে দাঁতে লিপস্টিক লাগানো। আইসক্রিম একটু পরত করে খাওয়া। দাদাদের নজর সরিয়ে প্যান্ডেলের ধারে একা দাঁড়িয়ে থাকা ওকে দেখে মুখের সামনের চুল সরিয়ে নেওয়া। সুরেলা কন্ঠে বাজছে ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’।

তবে, দুর্গাপূজা চারটে দিন যাই বলেন আয়োজন কিন্তু এলাহি থাকে ওদের। খাওয়ার শেষে ভরপেট জল পান। মুড গরম করে মন্ডপে ঘুরে বেড়ানো। নেতা নেত্রী, বরেণ্য মানুষের পাশে বসে সেলফি তুলে আমি তোমাদের লোক জাতীয় প্রশংসা নেওয়া৷ বিজয়ার মাঝেই বান্ধবী নরম আঙুলে লাল নেল পালিশ লাগিয়ে এগিয়ে আসে। ভাইয়ের সাথে ঠাকুর মন্ডপের পাশ থেকে একটু ইশারা। উফ, ‘জ্বলে পুড়ে যাক’। গলায় সোনার চেন জামার বাইরে উঁকি দিচ্ছে। কখন আসলে! অনুষ্ঠানের মূল দায়িত্ব আমার উপরে ই থাকে। দায়িত্ব বুঝলে নিশ্চইয়। কথা বলার অছিলায় ভাইকে একটু দোকানে পাঠানো। বন্ধুরা অপেক্ষায়। সবকিছু অঢেল। বাইকে ভরা তেল, টেবিলে সাজানো পানীয়। গ্লাস হাজির। চাট চাটনি সাজানো। অকেশনে একটু মায়ের ভক্ত হয়ে যাওয়া।

দুর্গাপূজা আসবার আগে এসে যায় মহালয়া । আর মহালয়া মানে উঠতে হয়েছে ভোর-ভোর। প্রান্ত মাঠ, ভেজা দূর্বা, জবা কুঁড়ি, কিছু শিউলি পাতায় আটকে কিছু বা ঘাসের উপর । বাকিটা সেকেলে ছোটবেলায় বিকেলের কবিতায় প্রেম। সন্ধ্যে নামলে লোডশেডিং হয়ে যাওয়া হ্যারিকেনের আলোয় বইয়ের পাতা উল্টে পড়া করা । বকা শুনতে হতো । জানিস প্রতিদিন কারেন্ট যায় বিকেল – বিকেল পড়তে কি হয়? ভাবতাম আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ, র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি। কবি লিখেছেন কাকতালীয় মোটেও ছিল না। এ যেন প্রকান্ড মাঠে উনুন বানিয়ে ডিমের ঝোল ভাত রেঁধে খাওয়া। দূরে জমিতে বসানো বেগুন গাছ থেকে লুকিয়ে তুলে আনা বেগুন ফালি করে ভাজা।

ছোটবেলায় টিভিতে চ্যানেল বলতে শুধুমাত্র দূরদর্শন। একবার বাঁশ টা ঘুরিয়ে দে না। বড্ড ঝিরঝির করছে। দেখে নেওয়া শহরের দুর্গাপূজা পরিক্রমা। সময় বদলেছে শুধু রয়ে গিয়েছে আবেগ। অষ্টমীর অঞ্জলি, বেলপাতা আতপ চাল ধূপের গন্ধে মাতৃ আরাধনা। বাকিটা চেনা ছন্দে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। অনেক ছবি তোলা। নবমী মাংসের দোকানে লম্বা লাইন। দশমিক বিন্দু অপেক্ষায় ঠাকুর আসবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে,,,,

error: Content is protected !!