অর্ঘ্য মাহাতোঃ অবশেষে “ইতি,মা দূর্গা” বলার সময় এসে গেল এবং মায়ের যাত্রাপথ কৈলাশের দিকে আরম্ভ হল। প্রারম্ভে মায়ের মর্তে আগমন আবহাওয়া বিরূপ হলেও ইন্দ্রাদেবের কৃপায় উৎসবের ব্যাপ্তি ও ভক্তদের আনন্দে ভাটা পড়তে দেয়নি। এই উৎসব শুধুমাত্র ভক্তদের আনন্দের জন্য তো নয়, এর উপর নির্ভর করছে কোটি কোটি সম্ ও ভিন্ন সম্প্রদাইয়ের মানুষদের রুজি-রোজকার।

বারো মাসে তেরো পার্বনে এই উৎসবে পাখির চোখ থাকে ব্যবসার সাথে যুক্ত সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের। কলকাতা থেকে মফস্বলের রাস্তার ধারে হোর্ডিঙে চোখে পরে পুজোর স্পেশাল অফার। আবার পুজো মণ্ডপের আশেপাশে অপেক্ষায় থাকে ব্যবসায়ী শ্রেণীর ছোট উদ্যোগপতিরা । মফস্বলের সাথে শহর মিশে যায় উৎসবের মেলবন্ধনে । সেটি ব্যবসায়ী হোক বা ভক্তের সমাগমেই হোক । পঞ্চমীর বিকাল শিয়ালদাহ স্টেশন চত্বরে যে শতশত ঢাকের প্রতিফল শোনা যায় , সেটি এই মেলবন্ধনে একপক্ষের অন্যপক্ষের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান করে । গ্রাম থেকে আগত ঢাকিদের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে অচেনা মহানগরে আকাঙ্খিত খদ্দেরের সাথে একটি সুবিধাজনক কারবার করা। ডিজে বক্স, পাশ্চাত্য সংগীতের ভিড় তাদের উপার্জন কমিয়ে দিলেও পুজোর রীতিনীতিতে ও বুনিয়াদি মণ্ডপে তাদের অস্তিত্ব ভেসে বেড়ায় । সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। যেমন ভাবে উৎসব প্রাঙ্গন থেকে হারিয়ে গেছেন মান্না দে, অঞ্জন দত্ত থেকে রূপঙ্কর , নচিকেতা । আমাদের গ্রহণযোগ্যতাই গুরুত্ব পেয়েছে কম্পিউটারের সহায়তায় তৈরী গায়কদের কণ্ঠস্বর অথবা পাশ্চাত্য সঙ্গীত ।
ছবি-প্রদীপ সাঁতরা
যে উৎসব তৈরী করতো হাজার হাজার মানুষের রুজি রোজগার আজ তারা মুক্তি চাই তাদের পূর্বপুরুষ থেকে আগত উৎসবের শিল্প থেকে।দশমীর বিসর্জনে বিদায়ের সুরে থেকে যায় বিষাদের গান । মায়ের চলে যাওয়া আবার প্রতীক্ষায় ফিরে আসা । ঐতিহাসিকভাবে মায়ের এই অকাল বোধনের সূচনা করেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র । পত্নী শোকে বিহ্বল হলেও তার প্রতি ভালোবাসায় বর্তমান মধ্যপ্রদেশ থেকে সুদূর শ্রীলংকার তিন হাজার পথ অতিক্রম করা এবং নিজের রাজ্য থেকে সাহায্য না নিয়ে তার পথে আগত সাধারণ মানুষদের নিয়ে তৈরী করা সেনাবাহিনী নিয়ে লঙ্কা জয় করে পত্নীলাভ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে শরতের এই লগ্নেই তিনি মা দুর্গার অকাল বোধন করেন ও আর্শীবাদ নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেন। দশমীতে লংঙ্কাতে রাবনরাজের সমাপ্তি ঘটে । তাই এইদিনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে রাবনবধ উৎসব করা হয় । একই ভাবে এই দিনেই মা দূর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন । সত্যের জয় হোক বা অন্যায়ের অবসান নারীশক্তিকে সর্বদাই সম্মান জানানো হয়েছে। হাজার হাজার বছর পুরোনো মনুস্মৃতিতে সেই জন্যেই হয়তো লেখা হয়েছিল “যত্র নারায়স্তূ পূজ্যান্তে , রমনতে তত্র দেবতা ” অর্থাৎ নারীকে যেখানে পুজো করা হয় সেখানেই ভগবানের অবস্থান হয়ে থাকে ।
ছবি-প্রদীপ সাঁতরা